নিউট্রিনো - একটি ভুতুড়ে কণার গল্প (বিজ্ঞান)


নিউট্রিনো - একটি ভুতুড়ে কণার গল্প


আমাদের এই বিশ্বজগতে সবকিছুরই একটা নির্দিষ্ট বিশ্লেষণ আছে। সবকিছুকে আমরা সহজেই ব্যাখ্যা করতে পারি কোনো পন্থা অবলম্বন করে। কিন্তু যুগে যুগে এমন কিছু মাথা নষ্ট করা বিষয় আমাদের সামনে আসে, যা আমাদের ভাবায়। এই ভাবনার জন্যই তো যেকোনো বিষয় ব্যাখ্যা করা সম্ভব। কিন্তু কিছু বিষয় আছে, যার ব্যাখ্যা দিয়েও সবার একটু মানতে বা বুঝতে কষ্ট হয়। আসলে আমরা যা দেখতে পাই, তাই বিশ্বাস করি। এটা একটা চিরন্তন সত্য বটে! এই কথা বলার কারণ হলো আজকে আমরা এমন এক বিশেষ কণা সম্পর্কে জানবো, যা খালি চোখেও দেখা যায় না ও বন্ধ চোখে তো না'ই। বিষয়টা অনেক অদ্ভুত তাই না।


আমরা জানি, আমাদের আসে-পাশে সকল কিছু পদার্থ দিয়ে বিস্তৃত। পদার্থকে ভাঙতে থাকলে আমরা অণু বা পরমানু পাবো। আরো যদি ভাঙা যায় তবে আমরা পাবো ইলেক্ট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন। এদের ভাঙলে কোয়ার্ক ও স্ট্রিং নামক আরেকটি বিশেষ কণা পাওয়া যাবে। কণা এগুলো খালি চোখে না দেখা গেলেও বিশেষ ধরনের ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে দেখা যায়। কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে এমন একটা কণা আছে দেখা যায় না। সে যেকোনো পদার্থকে ভেদ করে যেতে পারে এবং এর ভর এতই কম যে একে নাম দেওয়া হয়েছে গোস্ট পার্টিকেল (Ghost Particle) বা ভুতুড়ে কণা। নামটা অনেক অদ্ভুদ তাই না। সবই তো ঠিক আছে কিন্তু এই কণাটির যদি এমনই বৈশিষ্ট্য হয় তবে কিভাবে এর অস্তিত বুঝতে পারলো বিজ্ঞানীরা। আজকে পুরো এই বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

নিউট্রিনো মডেল (সম্ভাব্য)


গোস্ট পার্টিকেল (Ghost Particle) বা ভুতুড়ে কণা এমন একটি কণা যা যেকোনো পদার্থ বা ম্যাটার (Matter) এর মধ্য দিয়ে এপার-ওপার হয়ে যেতে পারে। একে দেখা যায় না কিন্তু এর অস্তিত্ব পরিলক্ষিত করা যায়। তো কিভাবে এর অস্তিত্ব খুঁজে পায় বিজ্ঞানীরা?


১৯ শতকের দিকে বিজ্ঞানীরা মনে করতো পরমাণুকে ভাঙলে শুধুমাত্র ইলেকট্রন ও প্রোটন পাওয়া যাবে এবং তারা তাই দেখতে পেত। এতে কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু কোনো বেশি ভর বিশিষ্ট পরমাণুতে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে পরমাণুগুলো থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিবর্তিত হয়। ভারি পরমাণুগুলো থেকে ইলেক্ট্রন নির্গত হয়। এই বিষয়টা সেই সময় অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। এই ঘটনাটা শক্তির সংরক্ষণশীলতার নীতি লঙ্ঘন করে। আমরা জানি যে, কোনো ঘটনা ঘটার আগে ও পরে মোট শক্তি এক থাকবে। অর্থাৎ শক্তির কোনো সৃষ্টি বা বিনাশ নেই। কিন্তু বিজ্ঞানীরা লক্ষ করলো যে ভারি পরমাণু থেকে ইলেক্ট্রন নির্গত হওয়ার আগে ও ইলেক্ট্রন নির্গত হওয়ার পরে শক্তি নির্ণয় করে দেখে যে কিছুটা শক্তি কমে গেছে। অর্থাৎ শক্তি হ্রাস পেয়েছে। এই বিষয়টা বিজ্ঞানীদের অনেক ভাবায়। পরে আলবার্ট আইনস্টাইনের ব্যাচের এক বিজ্ঞানী 'ওলফগ্যাং পাউলি' (Wolfgang Pauli) বলে যে এখানে এমন এক ধরনের পার্টিকেল বা কণা আছে মানুষ আগে কখনো দেখেনি বা ডিটেক্টও করেনি। তিনি আরও বলেন, যে ভারি পরমাণু থেকে ইলেক্ট্রন নির্গত হওয়ার সময় আরো একটা কণা নির্গত হয় যাকে না দেখা যায়, না ডিটেক্ট করা যায়। এই নির্গত হওয়া কণা ডিটেক্ট করতে পারলে দেখা যাবে এই কণাই পরমাণুটির হারানো শক্তি বহন করেছে, তখন দেখা যাবে শক্তির সংরক্ষণশীলতার নীতি লঙ্ঘন হচ্ছে না। তার এই মতবাদ অনেকে মেনে নেননি আবার অনেকে গুরুত্বের সঙ্গে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করেন। এই বিষয়টি নিয়ে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেন 'এনরিকো ফার্মি' (Enrico Fermi)। তিনি এমন একটা কণার সন্ধানে ছিল যার কোনো চার্জ নেই ও ইলেক্ট্রনের থেকে অনেক ছোট এবং তা কোনো পরমাণুর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এমন আচরণ করে যেন তার সামনে কিছু নেই। তিনি এই কণার নাম দেন "নিউট্রিনো"। আর এইভাবেই শুরু হয় নিউট্রিনো যাত্রা। 


যদি পরমাণুর এরুপ ভাঙ্গনের ফলে নিউট্রিনো নির্গত হয়, তবে নিউট্রিনো ডিটেক্ট করার উপযোগী পরিবেশ হবে 'নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ'। এই চিন্তা মাথায় নিয়েই প্রথম দুজন বিজ্ঞানী সে অনুযায়ী একটা মডেল তৈরি করে। কিন্তু তারা যা ভাবছিলো তা আসলে অতটাও সুবিধার হবে না, যার ফলে তারা অন্যকিছু ভাবতে শুরু করলো। তারা একটা জিনিস ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখলো যে, বিষয়টি অন্যরকমও হতে পারে। যেখানে বলা হয়েছে পরমাণুর ভাঙনের ফলে সেখান থেকে ইলেক্ট্রন ও নিউট্রিনো নির্গত হবে কিন্তু এমনও হতে পারে কোনো এক সময় হয়ত নিউট্রিনো চলার পথে নিউক্লিয়াসের সাথে বাধাপ্রাপ্ত হয়। আর তখন সেখান থেকে নিউট্রন ও পজিট্রন নির্গত হবে। আর এটাকে যদি সঠিক তরলের মধ্যে প্রবেশ করানো যায় তবে সেখান থেকে একটা আলোক ফুলকি দেখা যাবে বা লাইট ফ্লাস দেখা যাবে। আর এভাবেই নিউট্রিনো ডিটেক্ট করা সম্ভব।


এই পদ্ধতিকেই কাজে লাগিয়ে আজ বিশ্বে প্রায় সব জায়গায় নিউট্রিনো ডিটেক্টর লাগানো হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে জানিয়ে রাখা ভালো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিউট্রিনো ডিটেক্টর সাউথ পোলে অবস্থিত। 


আমরা জানি পারমাণবিক কেন্দ্রে সূর্যের বিপরীত প্রতিক্রিয়া সংঘটিত হয়। যেখানে পারমাণবিক কেন্দ্রে অনেকগুলো পরমাণু ভেঙে ছোট আকারে পরিণত হয় এবং  সূর্যে তার বিপরীত ঘটনা ঘটে। সূর্যে একাধিক পরমাণু একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে বড় আকৃতির পরমাণুতে রূপান্তরিত হয়। আর এই ঘটনা থেকে নিউট্রিনো ডিটেক্ট করা সম্ভব। সুতরাং সূর্য থেকে নিউট্রিনো পাওয়া সম্ভব। 


এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই নিউট্রিনো ডিটেক্ট করে হবে কি? কেন সবাই নিউট্রিনোর পিছনে পরেছে?

আমাদের এই বিশ্বজগতে ডার্ক এনার্জি (Dark Energy) বা অন্ধকার বা কালো শক্তি বলে একটা জিনিস আছে ও তারই সূত্র ধরে এসেছে ডার্ক ম্যাটার (Dark Matter) । আর আমরা যা কিছুই ব্যবহার করছি বর্তমানে তাকে বলে ম্যাটার বা পদার্থ। যদি এদের শতকরা হিসাব করা হয় তবে দেখা যায়, ডার্ক এনার্জি ৬৮%, ডার্ক ম্যাটার ২৭% এবং শুধু ম্যাটার বা পদার্থ ৫% এরও কম।

মূলত সবাই মনে করছে এই নিউট্রিনো সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পারলে বা এর সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারলে ডার্ক এনার্জি ও ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে একটা নতুন তথ্য তাদের সামনে আসবে। যার দ্বারা বিশ্বজগতকে জানা আরোও শহ হয়ে যাবে। মূলত এই কারণের সবাই এর পিছনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।


'নিউট্রিনো' শব্দটি যতটা ছোট ততটাই ছোট এর আকার কিন্তু এর ব্যাখ্যা মোটেও ক্ষুদ্র নয় বরং আরো অনেক বিস্তৃত। তাই আজকে এই সম্পর্কে একটা ধারনা দিয়েই শেষ করছি। 

আমাদের সাথেই থাকুন, ভালো লাগলে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না। 


- ধন্যবাদ

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন