রুপকথা নাকি সত্য | হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা


রুপকথা নাকি সত্য | হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা 


    আসসালামু আলাইকুম

⊕ মূল গল্প ⊕

হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার গল্প আমরা সবাই জানি কিন্তু এই গল্পটি কি শুধুই গল্প নাকি বাস্তব! চলুন জেনে নেওয়া যাক। একটি পৃথিবী বিখ্যাত কাহিনী হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। হ্যামিলনের সেই বাঁশিওয়ালার গল্প আমরা সবাই জানি। ঘটনাটি মূলত জার্মানের হ্যামিলন শহরের, আজকের মতো এতো উন্নত পরিবেশ বা উন্নত শহরের একাংশও তখন ছিল না। শহরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একাদশ শতাব্দীতে। সময় তখন ১২৮৪, ২২ জুলাই, জার্মানির লোয়ার সাক্সনির হ্যামিলন শহর যা তখনকার সময়ে বেশ এলোমেলো শহরের মধ্যে একটি ছিল। এই হ্যামিলন শহরটি তখন জার্মানি হানোভারের থেকে প্রায় ৩৩ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত ছিল। 

একদিন হঠাৎ করে সমস্ত গ্রাম ইঁদুরে ভরে যায়। ইঁদুরগুলো আকারে বেশ বড় এবং সংখ্যায় অধিক তাই বিড়ালও ইঁদুর দেখে ভয়ে পালিয়ে যেত। আস্তে আস্তে বাসা-বাড়ি থেকে শুরু করে ফসলের মাঠ, রাস্তা-ঘাট, বাজার, সব জায়গায় ইঁদুরের প্রকোপ বাড়ে। সব মিলিয়ে আশে-পাশের মানুষজন এই ব্যাপার নিয়ে বিরক্ত প্রকাশ করে। ঠিক তখনই ছোট্ট শহর হ্যামিলনে দেখা দেয় মহামারী। গ্রামের মানুষ ধারণা করে ইঁদুরের মাধ্যমেই পুরো গ্রাম আজকে মহামারীর শিকার। উপায় না পেয়ে নির্বিশেষে সবাই এক জোট হয়ে সিদ্ধান্ত নেন পৌরসভার মিটিং করার জন্য। পরবর্তীতে শহরের মেয়র জানান, যে ব্যক্তি গ্রামবাসীকে ইঁদুরের হাত থেকে মুক্তি প্রদান করতে পারবে তার জন্য থাকবে বেশ মোটা অংকের একটি পুরস্কার। এই ভাবেই সম্পূর্ণ গ্রামে প্রচার করা হয় পুরস্কারের কথা।

ঐ ঘোষণায় সাড়া দিয়ে হ্যামিলনে উপস্থিত হয় রহস্যময় এক বাঁশিওয়ালা। বাঁশিওয়ালা বলেন তিনি পুরস্কারের পরিবর্তে গ্রামের সমস্ত ইঁদুর দূর করে দিতে পারবেন। গ্রামের মেয়র কিছুটা অবাক হয়ে বাঁশিওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করেন তিনি কিভাবে ইদুর তাড়াবেন? বাঁশিওয়ালা উত্তরে বলেন তার বাঁশির সুর দিয়ে ইঁদুরদের নিয়ে যাবেন শহরের বাহিরে। এই কথা শুনে গ্রামের মানুষরা অবাক হয়। তারা বাঁশিওয়ালাকে নিয়ে মনে মনে ঠাট্টা করা শুরু করেন। ঠাট্টা করলেও তারা এই বিপদ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নিরুপায় হয়ে বাঁশিওয়ালাকে বিশ্বাস করেন এবং তাকে সুযোগ দেন কাজ করার। গ্রামের ধন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও মেয়র বাঁশিওয়ালার প্রস্তাব মেনে নিয়ে আদেশ দেন তার কাজ শুরু করতে। বাঁশিওয়ালা আদেশ পেয়ে বাঁশি বাজাতে শুরু করলেন। তার বাঁশির সুর ছিল মায়াবী ও অদ্ভুত। তার বাঁশির মায়াবী সুরে যেন ইঁদুরগুলো সম্মোহিত হয়ে যার যার গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে। যেখানে যা ইঁদুর ছিল সব একত্রিত হয়ে বাঁশিওয়ালাকে অনুসরণ করতে থাকে। এরপর বাঁশিওয়ালা সেই ইঁদুরগুলোকে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়ে আসে "ওয়েজার" নামক একটি নদীতে।

বাঁশিওয়ালা তার কাজ শেষ করে ফিরে আসেন গ্রামে। মেয়রের কাছে তার পুরস্কার চাইলে মেয়র তাকে ফিরিয়ে দেন। বাঁশিওয়ালা অনেক রেগে যান এবং ঐ শহর ত্যাগ করেন। বাঁশিওয়ালার সাথে সাথে ইঁদুর ও মহামারী দুটোই চলে যায়। গ্রামের মানুষ তখন আবার স্বাভাবিক জীবন কাটাতে শুরু করেন। কিন্তু সামনে তাদের জন্য আরো বড় বিপদ অপেক্ষা করছিল। কিছুদিন পরের কথা!

ধর্মীয় উৎসবে মুখোর হয়ে উঠেছে গ্রাম হ্যামিলন। সবাই একত্রে গির্জায় প্রবেশ করেন উৎসবে সামিল হওয়ার জন্য। বড়রা ছোট বাচ্চাদের নিয়ে উৎসবে যখন মেতে আছে ঠিক তখনই হঠাৎ ফিরে আসে সেই রহস্যময় বাঁশিওয়ালা। আবারো সুর উঠে বাঁশিওয়ালার বাঁশিতে কিন্তু এইবার মায়াবী সেই বাঁশির সুরে বেরিয়ে আসতে থাকলো গ্রামের ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চারা। গ্রামের বড়রাও সেই সুরে হারিয়ে ফেলে তাদের বোধ শক্তি যার ফলে কিছু করতে পারে না। বাঁশিওয়ালা ঠিক ইঁদুরদের মতোই বাচ্চাদের সলিল সমাধি দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল। তারপর বাঁশিওয়ালা গ্রামের বাচ্চাদের নিয়ে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায় ঐ গ্রাম থেকে। ঐ বাচ্চাদের সাথের ২ টি বাচ্চা কোন কারণে পিছনে পরে যায়। পরবর্তীতে যখন বাচ্চা দুটির সম্মোহিত ভাব কেটে যায় তখন ঐ দুই বাচ্চা গ্রামে এসে জানায় বাঁশিওয়ালার ব্যাপারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ঐ দুই বাচ্চার মধ্যে একজন বোবা আর একজন দৃষ্টিহীন হওয়ায় তারা বাঁশিওয়ালার সঠিক গন্তব্বের ব্যাপারে সঠিক তথ্য দিতে পারে না। গ্রামের মানুষ এসব দেখে ভয় পেয়েছিলেন। সবাই খুঁজতে লাগেন ঐ বাঁশিওয়ালাকে কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল।

আসলে মূল গল্পটি এমনই কিন্তু এরপর নানান জনের নানান মতবাদ রয়েছে ঐ বাঁশিওয়ালাকে নিয়ে।


⊕ নানান মতবাদ ⊕

কেউ বলেন বাঁশিওয়ালা বাচ্চাদের নিয়ে কোপেলবার্গ পাহাড়ের গুহায় ঢুঁকে গিয়েছিল তারপরই গুহার দরজা বন্ধ হয়ে যায়। আবার কেউ বলেন বাঁশিওয়ালা গ্রামের বাচ্চাদের নিয়ে উধাও হয়ে যায়। ইতিহাসবিখ্যাত এই কাহিনী নিয়ে বিতর্কের কোন শেষ নাই। দীর্ঘদিন এই ঘটনা নিয়ে বিস্তর গবেষণা করা হয়েছে কিন্তু শেষ অবধি তার কোন প্রমান বা নথিপত্র পাওয়া যায়নি। বিষয়টি এখানেই থেমে যায় সেইবারের মতো।


⊕ বাঁশিওয়ালার বিবরণ ⊕

হ্যামিলন গ্রামের রহস্য তুলে ধরে একটি জাদুঘর নির্মাণ করা হয়। সেই জাদুঘরে কিছু বই পাওয়া যায় যা পঞ্চাদশ শতাব্দীতে লেখা। সেখানকার কিছু বইয়ের মধ্যে থেকেই হ্যামিলন শহরের সেই বাঁশিওয়ালার বিবরণ পাওয়া যায়। ঐ বইয়ে একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য মিলে। প্রত্যক্ষদর্শী যিনি তার নাম "ফ্রাউ ভন লিউড" বয়স ১৩ বছর। ফ্রাউ ভন লিউড বলেন বাঁশিওয়ালা দেখতে অসম্ভব সুন্দর ছিলেন। তার বয়স আনুমানিক ৩০ বছর হবে। তার বাঁশিটি ছিল রুপার তৈরি।


⊕ বাঁশিওয়ালার প্রমাণ ⊕

পঞ্চাদশ শতাব্দীতে লেখা ঐ বইটি প্রথম নথি হিসাবে ধরা হয়। দ্বিতীয় নথি অনুযায়ী হ্যামিলন শহরে বাস করতো নিকোলাস নামের একজন অসৎ লোক। তিনি শিশুদের মধ্যপ্রাচের দিকে বিক্রি করে দিতেন বলে পাওয়া যায়। অনেকেই ভাবেন হয়তো এখানে নিকোলাস সেই বাঁশিওয়ালা কিন্তু এই কথার কোন উপযুক্ত প্রমাণ না থাকায় বিষয়টি এখনো আলোচনা সাপেক্ষে রয়েছে। কারণ বাঁশিওয়ালা ঐ গ্রামের কেউ ছিল না তাকে গ্রামের কেউ কখনো ইঁদুর তাড়ানোর আগে বা বাচ্চা হারানোর পরে দেখেনি। সে যেন গায়েবী কেউ ছিল।


হ্যামিলনের বর্তমান অবস্থা ⊕

জার্মানের হ্যামিলন শহরের একটি রাস্তার নাম "ব্যাঙ্গেলোসেন্ট্রাস" যার অর্থ "যে রাস্তায় বাজনা বাজে না"। ঐ রাস্তায় কাঠের ফলকে খোদাই করা রয়েছে ১৮২৪ সালের ২৬ জুন এক রঙচঙা ব্যক্তি ১৩০ জন বাচ্চাকে অপহরণ করে এবং হারিয়ে যায় তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞানীরা বলেন মধ্যযুগে ইউরোপে প্লেগ দেখা দিয়েছিল যা মহামারীর রুপ নেয়। আর ইঁদুরের মাধ্যমেই প্লেগ ছড়িয়ে ছিল সারা বিশ্বে। হ্যামিলনের জাদুঘরে বিজ্ঞানীরা টিনের তৈরি একটি বাঁশি রেখে দিয়েছেন তারা ধারণা করেন প্রাচীন সময়ে যারা ইঁদুর তাড়ানোর কাজ করতো তারা এই টিনের তৈরি বাঁশি ব্যবহার করতো কারণ তারা হাই ফ্রিকুয়েন্সির শব্দতরঙ্গের মাধ্যমে ইঁদুরদের আকৃষ্ট করতো। বাস্তবেও কিন্তু তাই বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণের পর জানায় ইঁদুরদের হাই ফ্রিকুয়েন্সির মাধ্যমে আকৃষ্ট করা সম্ভব।

১২৮৪ সালে জার্মানের হ্যামিলনে দুইটি ঘটনা ঘটে যা এখনো আমাদের ভাবনাকে স্থির করে দেয়। প্রথমটি প্লেগ মহামারী ও দ্বিতীয়টি নাচের রোগ। এক বিশেষ ধরনের খাদ্য বিষক্রিয়ার ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নাচতে থাকে রোগী। এই রোগে ছোট বাচ্চারাই বেশি আক্রান্ত হয়েছিল। তাদের সবাইকে লাল রঙ বেশ আকৃষ্ট করতো। বর্তমানে জার্মানের হ্যামিলনে ১৬০২ সালের তৈরি করা পৌরসভা রয়েছে যার বর্তমান নাম "ইঁদুর ধরা লোকের বাড়ি" এবং ঐ পৌরসভার দেয়ালে বেশ সুন্দরভাবে কাহিনীটির ছবি আঁকা আছে।


- ধন্যবাদ    


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন